ইঁদুর নিধনে প্রকৃতি, ফসল ও মানুষের কল্যাণ
এ এফ এম হায়াতুল্লাহ
ইঁদুর খুবই পরিচিত একটি প্রাণী। মানুষের জীবনের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে রয়েছে ইঁদুর ও ইঁদুরের উপদ্রব। মানুষের সাহিত্য, যুদ্ধ, দুর্যোগ, বিপর্যয়, রোগশোক, অভাব, পরিবেশ ইত্যাদি জুড়ে আছে ইঁদুর। সবচেয়ে প্রাচীন সাহিত্য ঈশপের গল্পে যেমন আমরা ইঁদুর পাই, মধ্যযুগের জার্মান লোকসাহিত্যেও আমরা ইঁদুরের উপদ্রবে অতিষ্ঠ হ্যামিলন শহরের দেখা পাই। হ্যামিলনের ইঁদুর নিধনকারী সেই বাঁশিওয়ালা আমাদের ইঁদুরের কবল থেকে মুক্তি দিলেও, বাস্তবে মানুষ আজো ইঁদুরের বিরুদ্ধে লড়াই করে যাচ্ছে। এই হাল আমলেও পৃথিবীর অন্যতম সেরা শহর নিউইয়র্কের অলিগলি ইঁদুরের দখলে। নিউইয়র্কে মেয়র নির্বাচন হোক আর জাতীয় নির্বাচন হোক নির্বাচনী ইশতেহারে প্রার্থীরা ইঁদুর নিধনের প্রতিশ্রুতির কথা অবশ্যই উল্লেখ করেন। ওয়ার্ল্ড ডিজনির মিকি মাউস চরিত্রটি শিশুদের নিকট খুবই পরিচিত। শিশু-কিশোর-বয়স্ক সবার নিকট জনপ্রিয় কার্টুন ‘টম এন্ড জেরি’তে ইঁদুর চরিত্রের জেরি প্রায় সবারই পছন্দ। কিন্তু বাস্তবের জেরিদের পছন্দ করে এমন মানুষ খুবই কম রয়েছে।
ফসল, আসবাবপত্র ও গৃহস্থালির ক্ষতি করার জন্য ইঁদুর নিধনের চেষ্টাও মানুষের বহুকাল আগে থেকে। আর টিকে থাকার লড়াইয়ে ইঁদুরও জিততে চায়। মানুষের পুরো জাতিকে পৃথিবী থেকে বিলুপ্ত করে দেওয়ার জন্য যেসব রোগ এসেছে প্লেগ তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য। মানুষের জীবনবিধ্বংসী প্লেগ রোগ সৃষ্টিতে সরাসরি ইঁদুর জড়িত। ইঁদুর স্তন্যপায়ী হওয়ায় এর দংশন জলাতঙ্ক রোগেরও কারণ। আবার, ফসল নষ্ট করার জন্য ইঁদুর ইতিহাসের সূচনা থেকেই উপদ্রব হিসেবে আলোচিত হয়। আধুনিককালে যখন পরিবেশবিদরা বাস্তুসংস্থানের গুরুত্ব বর্ণনা করেন সেই সময়ও ইঁদুর নিধনের প্রয়োজনীয়তা অস্বীকার করা হয় না। কারণ, ইঁদুর প্রাণিজগতের সবচেয়ে বুদ্ধিমান প্রাণী মানুষের জীবন, খাদ্য, পোশাক ও বাসস্থানের ক্ষতিসাধন করে। তবে এটিও সত্য মানুষের প্রাণ রক্ষায় গবেষণাগারে গিনিপিগের পাশাপাশি ইঁদুরও প্রচুর ব্যবহৃত হয়। এ সত্ত্বেও ইঁদুর নিধন এখনো কার্যকর হওয়ার অন্যতম কারণ ইঁদুরের দ্রুতগতির প্রজনন সক্ষমতা এবং ইঁদুরনাশকের প্রতিরোধে অভিযোজিত হওয়ার আশ্চর্যজনক ক্ষমতা। এ কারণেই জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ উপলক্ষ্যে ইঁদুর নিধনে প্রকৃতি, ফসল ও মানুষের কল্যাণ বিষয়েবিশদ আলোচনা প্রয়োজন।
ইঁদুর (জধঃ) জড়ফবহঃরধ বর্গের গঁৎরফধব গোত্রের লম্বা লেজবিশিষ্ট একটি স্তন্যপায়ী প্রাণী। ইঁদুর জধঃঃঁং ও এর সমগোত্রীয় গণের অন্তর্ভুক্ত প্রজাতি। ইঁদুরের পরিবেশের সঙ্গে খাপখাওয়ানোর সক্ষমতা অধিক। এ কারণে এন্টার্কটিকা ছাড়া আর সব মহাদেশেই ইঁদুর দেখা যায়। সব ধরনের খাদ্যে অভ্যস্ততা এবং দ্রুত প্রজনন করার ক্ষমতার কারণে যেকোনো পরিবর্তনশীল পরিবেশে অভিযোজন করতে পারে ইঁদুর। চোয়ালের পেশীবিন্যাস ও করোটির নানা বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে রোডেন্ট বর্গের প্রাণীরা তিনটি দলে বিভক্ত: কাঠবিড়ালীসদৃশ, ক্যাভিসদৃশ ও ইঁদুরসদৃশ। স্তন্যপায়ীদের সর্বমোট প্রজাতির এক-চতুর্থাংশের বেশি তৃতীয় দলের অন্তর্ভুক্ত। গঁৎরফধব গোত্রের সহস্রাধিক প্রজাতির মধ্যে বাংলাদেশে আছে প্রায় ১৮ প্রজাতির ইঁদুর। বাংলাদেশে প্রাপ্ত ইঁদুরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য নেংটি ইঁদুর (গঁং সঁংপঁষঁং), কালো ইঁদুর (জধঃঃঁং ৎধঃঃঁং), ধেঁড়ে ইঁদুর (ইধহফরপড়ড়ঃধ রহফরপধ), মেঠো ইঁদুর (ইধহফরপড়ড়ঃধ নবহমধষবহংরং) ইত্যাদি।
ইঁদুর বাংলাদেশের ফসলের মাঠ থেকে ঘরের কোণে, দপ্তরসমূহ থেকে দোকানপাট সর্বত্র বিরাজমান। একাধিক সমীক্ষায় দেখা গেছে ইঁদুর পুরো পৃথিবীর ২০% পর্যন্ত ফসলের ক্ষতি করতে সক্ষম। এ কারণে আন্তর্জাতিক ধান গবেষণা কেন্দ্র (ওজজও) শুকনো ও বর্ষা উভয় মৌসুমে ইঁদুর নিধনের জন্য ইঁদুরনাশক ব্যবহারের জন্য কৌশলপত্র প্রণয়ন করে। যদিও ইরি অরাসায়নিক ইঁদুরনাশক ব্যবহার করতে উৎসাহ দেয় তথাপি এত বিপুলসংখ্যক ফসল ক্ষতির হাত থেকে রক্ষা পেতে মানুষের বিকল্প ভাবনার অন্ত নেই। বাংলাদেশেও প্রতি বছর ফসলের জমিতে ইঁদুরের উপদ্রব বৃদ্ধি পায়। কৃষিবিজ্ঞানীদের মতে, বছরে বাংলাদেশের মোট ফসলের ৫-১২ শতাংশ ফসল নষ্ট করে ইঁদুর। ছোট্ট ভূখ-ে বাস করা ১৬ কোটি মানুষের খাদ্য নিরাপত্তায় এ পরিমাণ নিঃসন্দেহে চিন্তার বিষয়। এ কারণেই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযানের যৌক্তিকতা স্পষ্ট হয়। ২০১৫ সালে ‘দ্য ডেইলি সান’ এ প্রকাশিত ‘জধঃং ফবংঃৎড়ু ১২-১৫ ঢ়বৎপবহঃ পৎড়ঢ়ং ধহহঁধষষু: বীঢ়বৎঃং’ শীর্ষক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের কৃষি ও কৃষকের জন্য ইঁদুরের ক্ষতিকর দিকটি তথ্য-উপাত্তসহকারে উল্লেখ করা হয়। এ প্রতিবেদনে বিশেষজ্ঞদের বরাত দিয়ে জানানো হয়, প্রতি বছর ইঁদুরের কারণে ৫-৭% আমন ধান, ৪-১২% গম, ৫-৭% আলু, ৬-৯% আনারস ও অন্যান্য ফল, ৪-৫% সবজি, ৮-৯% নারকেল, ৭-১০% সেচ পানি এবং ৩-৫% গুদামজাত শস্য বিনষ্ট বা ব্যবহার অনুপযোগী হয়। ইঁদুর এসব ফসল কেটে দেয় বা খেয়ে ফেলে।
ফসল নষ্টের পাশাপাশি ইঁদুর প্রায় ৬০ প্রকার রোগের প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ কারণ। একজোড়া ইঁদুর বছরে প্রায় ২৫০০টি ইঁদুর জন্ম দিতে পারে এবং প্রতিটি ইঁদুর জন্মের মাত্র দুই মাসের মধ্যে প্রজননক্ষম হয়ে উঠতে পারে বলে মানুষ ও কৃষির জন্য ইঁদুর নিধন করা অত্যন্ত জরুরি বিষয় বলে পরিগণিত হয়।
বাংলাদেশ বিশে^র উর্বর দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম। এখানে স্বল্প জায়গায় অধিক মানুষ বাস করলেও বিএডিসিসহ কৃষি মন্ত্রণালয়ের অন্যান্য দপ্তর-সংস্থার তত্ত্বাবধানে এবং বাংলার কৃষকের নিরলস শ্রম ও ঘামের বিনিময়ে বাংলাদেশ দানাশস্যে স্বয়ংসম্পূর্ণ। আর এই স্বয়ংসম্পূর্ণতা রক্ষার জন্যই ইঁদুর নিধনের প্রয়োজন অত্যাবশ্যক।
বাংলাদেশী কৃষকদের মধ্যে ইঁদুর নিধনের কৌশল হিসেবে বিষটোপ, গর্তে পানি দেওয়া, গর্তখোঁড়া, ফাঁদপাতা ও ধূ¤্রবিষ (ঋঁসরমধহঃ) জনপ্রিয়। বছরের একটি নির্দিষ্ট সময়ে বসতবাড়ি ও এর আশেপাশে, মাঠে বা বহু কৃষক বিষটোপ ব্যবহার করেন। বাংলাপিডিয়ার তথ্যমতে, বিষটোপে ইঁদুর মারার পরিমাণ মোট কৌশলের ৭৪%। প্রাকৃতিকভাবে বর্ষাকালের বা অন্য যেকোনো সময়ের বন্যা ইঁদুরের উৎপাত ও বিস্তারকে সীমিত করলেও অল্প সময়ে বংশবৃদ্ধি করায় ইঁদুরের কবল থেকে স্থায়ী মুক্তি মেলে না। প্রবল বৃষ্টিপাতে মেঠো-ইঁদুরের গর্তগুলোতে পানি ঢুকলে ওদের বাচ্চাগুলো মারা যায়। বনবিড়াল, বাগডাস, শিয়াল, প্যাঁচা, বাজপাখি, সাপ, গুইসাপ ও বিড়ালের মতো বিভিন্ন শিকারি প্রাণী খাদ্য হিসেবে মৃত বা জীবিত ইঁদুর খেয়ে থাকে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মানুষের একটি ক্ষুদ্র অংশের মধ্যে ইঁদুরকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণের অভ্যাস রয়েছে। তবে এসবও ইঁদুরের নিয়ন্ত্রিত অস্তিত্বের জন্য টেকসই সমাধান আনেনি।
বাংলাদেশের কৃষক, শ্রমিক ও সাধারণ মানুষ দীর্ঘদিন ধরে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে বাঁচার কৌশল নিয়ে ভেবেছে। সীমিত জ্ঞান ও সাধ্যের মধ্যে নানা কৌশল ও ফাঁদের সাহায্যে ইঁদুর নিধনের চেষ্টা করেছে। কৃষকরা বেশ কয়েক প্রকারের ফাঁদ ব্যবহার করছেন। এর মধ্যে কাঁচিকল, কাঠের ফাঁদ, বাঁশের ফাঁদ, মাটির ফাঁদ ও খাঁচাফাঁদ উল্লেখযোগ্য। কৃষকদের বসতবাড়িতে সর্বাধিক ব্যবহৃত ফাঁদ হলো ‘কাঁচি কল’। স্থানীয় হাটবাজারে খুবই স্বল্প টাকায় এই ফাঁদ কিনতে পাওয়া যায়। আবার গ্রামের মানুষের কারিগরি দক্ষতার কারণে অনেকেই ঘরেই এ ধরনের ফাঁদ তৈরি করেন।
এর বাইরে ঘরবাড়ি, দোকানপাট, পরীক্ষাগার ও গুদামে বিভিন্ন ধরনের ইঁদুর বিশেষ করে নেংটি ইঁদুর নিধনের জন্য আঠাযুক্ত বোর্ড অত্যন্ত কার্যকর। কার্ডবোর্ড (৩০ী৩০ সেমি.), কাঠের তক্তা বা দস্তার প্রলেপযুক্ত লোহার পাতের টুকরায় ইঁদুর ধরার আঁঠা (জড়ফবহঃ মষঁব) লাগিয়ে নির্দিষ্ট স্থানে ইঁদুর চলাচলের পথে ফেলে রাখা হয়। আঁঠাযুক্ত বোর্ডের ওপর দিয়ে হাঁটা বা দৌড়ানোর সময় ইঁদুর তাতে আটকা পড়ে। বহির্বিশে^ও এ পদ্ধতি জনপ্রিয়, বিশেষ করে এ পদ্ধতিতে ইঁদুর জীবিত ধরা যায় বলে অনেকের কাছে জনপ্রিয়।
গ্রামাঞ্চলে প্রায়ই নতুন গর্তে ধোঁয়া দিয়ে সেখান থেকে ইঁদুর বের করা হয়। এ ধোঁয়া তৈরির সময় বিশেষভাবে শুকনো মরিচ পোড়াও দেয়া হয়। ধোঁয়া ও মরিচের যৌথশক্তির নিকট পরাজিত ইঁদুর এক সময় গর্ত ছেড়ে বেরিয়ে আসে অথবা গর্তের অভ্যন্তরেই মরে যায়।
সময়ের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষ এখন কষ্টসাধ্য উপায়ে ইঁদুর নিধন থেকে বেরিয়ে রাসায়নিক নানা নিধনপণ্য ব্যবহার করে। যদিও পরিবেশবিদরা রাসায়নিক পদার্থ, বিষ ও বালাইনাশক দিয়ে ইঁদুর নিধনের বিরোধিতা করেন, তবুও তাৎক্ষণিক ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা করে অনেকেই এই নিষেধকে গ্রাহ্য করেন না।
রাসায়নিক ইঁদুরনাশকের মধ্যে রয়েছে জিঙ্ক ফসফাইড, ব্রোডিফ্যাকোয়াম (ইৎড়ফরভধপড়ঁস), ব্রোমাডিওলোন (ইৎড়সধফরড়ষড়হব), ফ্লোকোমাফেন (ঋষড়পড়ঁসধভবহ) ও ইউসিডিয়ন (ণঁংরফরড়হ) ইত্যাদি ইঁদুরনাশকের ব্যবহার। এগুলো বাংলাদেশে নিবন্ধিত ইঁদুরনাশক (জড়ফবহঃরপরফবং) এর মধ্যে বহুল ব্যবহৃত। জিঙ্ক ফসফাইড সাধারণত ২-৩% মাত্রায় ব্যবহার্য। ইঁদুরনাশকগুলো সাধারণত জৈব বা অজৈব যৌগিক পদার্থ এবং প্রথাগতভাবে (কার্যকারিতার ভিত্তিতে) ৪ শ্রেণিতে বিভক্ত: তীব্র এককমাত্রা বা অ-তঞ্চনরোধক, ক্রনিক বা বহুমাত্রা বা তঞ্চনরোধক, ধূপনবিষ ও বন্ধ্যাকরণ রাসায়নিক।
বাংলাপিডিয়ায় প্রকাশিত তথ্যানুযায়ী বাংলাদেশে ইঁদুর নিয়ন্ত্রণে কোন নিবন্ধিত বন্ধ্যাকরণ রাসায়নিক নেই। গর্তে, জাহাজে, গুদামে ও অন্যান্য অনুরূপ স্থানে ইঁদুর নিধনের জন্য অবশ্য কিছু ধূপনবিষ ব্যবহৃত হয়। এগুলোর মধ্যে উল্লেখযোগ্য ক্যালসিয়াম সায়ানাইড, অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড ও কার্বন-মনোক্সাইড। অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইডের ০.৬ গ্রাম দানা বা ৩.০ গ্রাম বড়ি পাওয়া যায়, যা বাতাসের আর্দ্রতা বা ভিজা মাটির স্পর্শে ফসফাইন গ্যাস অবমুক্ত করে। ধূসর গ্যাস উদগীরক গুঁড়া হিসেবে ব্যবহৃত সায়ানাইড থেকে একইভাবে হাইড্রোজেন সায়ানাইড গ্যাসও নির্গত হয়। প্রতিটি গর্তের মুখে ১-২টি অ্যালুমিনিয়াম ফসফাইড দানা বা বড়ি রাখলেই চলে। এটি বিভিন্ন বাণিজ্যিক নামে নিবন্ধিত ও বিক্রয় হয় যেমন- অ্যাগ্রিফস (ধমৎরঢ়যড়ং) ৫৭%, গ্যাসট্রোক্সিন (মধংঃৎড়ীরহব) ৫৭%, সেলফস (ংবষঢ়যড়ং) ৫৭%, কুইকফস (য়ঁরপশঢ়যড়ং) ৪৭%, অ্যালামফস (ধষঁসঢ়যড়ং) ৫৭% ও কুইকফাম (য়ঁরপশঢ়যঁস) ৫৭% ইত্যাদি।
তবে এসব রাসায়নিক পদার্থ নিয়ে বেশ প্রতিবাদী অবস্থায় রয়েছে পরিবেশবাদী সংগঠন ও সক্রিয়তাকর্মীরা। কারণ, মরা ও জীবিত উভয় ইঁদুরই বাজ, চিল, কাক, বনবিড়াল, বাঘডাশাসহ নানা প্রাণীর খাদ্য। বাংলাদেশের অনেকেই খুবই সস্তায় ইঁদুর মারার ভয়ানক বিষ ব্যবহার করে। এই মৃত ইঁদুর আবার আশেপাশে ফেলে দেয় যেটি মুরগী, কুকুর বা পাখপাখালী খাওয়ার আশঙ্কা থাকে। আবার, মাটির নিচে ফেলে দিলে তা থেকে উদ্ভিদের মধ্যেও এ বিষ আসতে পারে। পানিতে ফেললে তা মিশে যেতে পারে ফসল ও খাদ্যদ্রব্যে। এসব থেকে আসতে পারে মানুষের দেহেও।
ইঁদুর যদি রাসায়নিক ইঁদুরনাশক খেয়ে মরে তবে ইঁদুরখেকো পাখি ও প্রাণীদের দেহেও এ রাসায়নিক আসতে পারে এবং এভাবে এতে বিলুপ্তপ্রায় প্রজাতির প্রাণী ও পাখিও নিধন হতে পারে। ২০১২ সালের ১৪ নভেম্বর বিশ^খ্যাত ন্যাচার জার্নালে ‘করষষরহম ৎধঃং রং শরষষরহম নরৎফং’ শীর্ষক গবেষণা নিবন্ধে রিচার্ড লোভেট (জরপযধৎফ অ. খড়াবঃঃ) কানাডার ভ্যানকুভারে মৃত ১৩০টি পেচা ও বাজপাখির দেহে ইঁদুরনিধনে ব্যবহৃত ক্ষতিকর ডিডিটিসহ অন্যান্য রাসায়নিক উপাদান পাওয়ার কথা প্রকাশ করে ইঁদুরনিধনে ক্ষতিকর রাসায়নিক দ্রব্য ব্যবহার না করার পরামর্শ দেন। ২০১৬ সালে ব্রিটেনের গার্ডিয়ানে প্রকাশিত ‘ঊহারৎড়হসবহঃধষরংঃ ংববশং ঢ়ৎড়ঢ়বৎ ফরংঢ়ড়ংধষ ড়ভ ফবধফ ৎধঃং’ শীর্ষক প্রতিবেদনে মৃত ইঁদুর যা রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার করে নিধন করা হয়েছে তা নিরাপদে সংরক্ষণ না করলে পরিবেশের বিভিন্ন প্রাণী, উদ্ভিদ এমন কী মানুষও আক্রান্ত হতে পারে বলে জানানো হয়। এ কারণে উন্নতবিশে^ ইঁদুরের উপদ্রব থেকে রক্ষার জন্য রাসায়নিক বালাইনাশকের চেয়েও বন্ধ্যাত্বকরণকে অধিক গুরুত্ব প্রদান করা হচ্ছে (শিবব্রত বর্মণের ‘মানুষ বনাম ইঁদুর’, বিজ্ঞানচিন্তা, ২০১৯)।
ইঁদুরের প্রতি সহমর্মী হওয়ার সুযোগ একেবারেই কম। পরীক্ষাগারে মানুষের বিভিন্ন গবেষণায় যে পরিমাণ ইঁদুর প্রয়োজন তারচেয়ে কোটি গুণ বেশি ইঁদুর পৃথিবীতে রয়েছে। পশুপাখির খাদ্য হিসেবেও ইঁদুর হয়তো প্রয়োজনীয়, কিন্তু ইঁদুরের যে বংশবৃদ্ধির হার তাতে এসব প্রাণীর জন্যও ইঁদুর হুমকি হয়ে উঠতে পারে। এ কারণেই আবু দাউদ শরিফের একটি হাদিসে এসেছে,‘যখন তোমরা ঘুমাবে তখন বাতি নিভিয়ে দেবে। কারণ শয়তান ইঁদুর ইত্যাদির অনুরূপ প্রাণীকে এমন কাজে প্ররোচিত করে এবং তোমাদের (ঘরবাড়িতে) আগুন লাগায়।’ (জাগোনিউজ২৪, ২০২০)।
ইঁদুর নিধনের জরুরি আবশ্যকতা রয়েছে। তবে ইঁদুর নিধনে ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ ব্যবহার না করে পরিবেশবান্ধব পদার্থ, ফাঁদ ইত্যাদি ব্যবহার করা সমীচীন। আবার, নিধনকৃত ইঁদুর প্রকৃতিতে এমনভাবে বিলীন করতে হবে যেন মাটি থেকে পানি, পশু থেকে পাখি, অণুজীব থেকে উদ্ভিদ-ফসল কেউই ইঁদুরের মাধ্যমে আক্রান্ত না হয়।
ইঁদুর নিধন অভিযানে ইঁদুরের উপদ্রব থেকে কৃষি, কৃষক ও সাধারণ মানুষ সুরক্ষা পাক এই লক্ষ্যে জাতীয় ইঁদুর নিধন অভিযান ২০২২ সফল হোক।
লেখক : চেয়ারম্যান (গ্রেড-১), বিএডিসি, মোবাইল: ০১৯৯৮৭৭০০০১, ইমেইল : chairman@badc.gov.bd